Abstract:
আব্বাসীয় আমলে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিনড়ব শাখায় বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্রে মুসলমানগণ এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করতে সক্ষম হন। রাসূলুলাহ (সা.)-এর চাচা হযরত ‘আব্বাস (রা.)-এর পঞ্চম অধস্তন পুরুষ আবুল ‘আব্বাস আস সাফ্ফাহ প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের খিলাফতই ইতিহাসে আব্বাসীয় শাসনামল হিসেবে পরিচিত। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল যাব নদীর তীরে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে উমাইয়াহ বংশের সর্বশেষ খলীফা দ্বিতীয় মারওয়ানের পরাজয়ের মাধ্যমে উমাইয়াহ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.) শাসনের অবসান ঘটে এবং আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা খলীফা হিসেবে আবুল ‘আব্বাস আস সাফফাহ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুদীর্ঘ পাঁচশত আট বছর স্থায়ী এ খিলাফতকালে সর্বমোট ৩৭ জন খলীফা খিলাফতে অধিষ্ঠিত থেকে মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ সাধনে বিশ্ব ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
খলীফাগণের পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা পত্র-পল্লবে সুশোভিত হয়ে সুবিশাল মহীরূহে পরিণত হয়। শিক্ষা সংস্কৃতি ও জ্ঞান বিজ্ঞানের উনড়বয়নের জন্য খলীফাগণের অক্লান্ত পরিশ্রম, সর্বোচ্চ ত্যাগ ও পৃষ্ঠপোষকতার ফলশ্রুতিতে তাঁদের রাজদরবার ছিল জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, পন্ডিত, আলিম, কবি, সাহিত্যিক ও মনীষীগণের মিলনকেন্দ্র। এজন্যই মুসলিম ঐতিহাসিকগণ এ যুগকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করেছেন।
আব্বাসীয় আমলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পর্যালোচনায় লক্ষণীয় যে, বিরাজমান কৃষ্টি-কালচার, শিক্ষা সংস্কৃতি, রাষ্ট্রনীতি, রূপশিল্প, সাহিত্য, ধর্ম, চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস মূল্যবোধ ও জীবন সামগ্রী উপভোগের মানসিক গঠন ইত্যাদি সামাজিক ও প্রাকৃতিক প্রভাবে গোটা বিশ্ব প্রভাবিত হয়েছিল। বাগদাদ থেকে পরিচালিত এ শাসন ব্যবস্থার প্রভাবে মুসলিম বিশ্ব কৃষ্টি ও সভ্যতার ক্ষেত্রে অভিনড়ব রূপ পরিগ্রহ করে। এ সময়ে মুসলমানদের পাশাপাশি অমুসলিম নাগরিকগণও রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে নিয়োগ লাভসহ সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ অধিকার লাভ করে।
ধর্মীয় অঙ্গনে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্রে মুসলমানগণ এ আমলেই বিকাশ লাভের স্বর্ণচূড়ায় আরোহণ করেন। রাসূল (সা.) ও সাহাবীগণের যুগে তাফসীর চর্চার সূত্রপাত হলেও উমাইয়াহ যুগে এর অগ্রযাত্রা শুরু হয় এবং আব্বাসীয় শাসনামলে এর দিগন্ত সম্প্রসারিত হয়ে পূর্ণতা লাভে সক্ষম হয়। বিশুদ্ধতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ সহীহ হাদীছের সমন্বয়ে সংকলিত গ্রন্থাবলি এ সময়েই প্রণীত হয়। বিশ্বব্যাপী ইসলামের দিগন্ত সম্প্রসারিত হলে প্রয়োজনের তাগিদে আল কুরআন ও হাদীছ ভিত্তিক বিভিনড়ব মাস’আলার প্রামাণিক দলিল তথা ফিকহ শাস্ত্র এ সময়ই সমৃদ্ধ রূপ পরিগ্রহ করে।
আব্বাসীয় খলীফাগণের পৃষ্ঠপোষকতায় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমানদের যে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ সাধিত হয়েছিল তা আজও বিজ্ঞান জগতে দিক নির্দেশনার ভূমিকায় অব্যাহত রয়েছে। এ সময়ে মুসলিম বিজ্ঞানীগণ রসায়ন শাস্ত্রে ব্যাপক গবেষণা, অসংখ্য গ্রন্থ রচনা ও অসামান্য অবদানের মাধ্যমে বিজ্ঞান শাখার প্রভূত উনড়বতি সাধন করেন। দূরবিন, দিকদর্শন যন্ত্র, দ্রাঘিমা ও অক্ষরেখা সংক্রান্ত সারণী আবিষ্কারসহ বিভিনড়ব ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে ভূগোল শাস্ত্রে এ সময়ে মুসলিম পন্ডিতগণ যথেষ্ট অবদান রাখতে সক্ষম হন। মানমন্দির স্থাপন এবং বিষয়ভিত্তিক অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করে মুসলিম বিজ্ঞানীগণ এ আমলে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চায় প্রভূত অগ্রগতি সাধন করেন। তাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম ও অদম্য সাধনার মাধ্যমে অসংখ্য গ্রন্থ আরবীতে অনুবাদ করে এবং নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞান ও গণিত শাস্ত্রে উলেখে যাগ্য অবদান রেখে আব্বাসীয় যুগকে বিশ্ব ইতিহাসের মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন।
উমাইয়াহ যুগে সীরাহ চর্চার অগ্রযাত্রা শুর“ হলেও আব্বাসীয় আমলে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ সীরাহ ও মাগাযী চর্চার পাশাপাশি চরিত ইতিহাস, জাতির ইতিহাস, আঞ্চলিক ইতিহাস ও বিশ্ব ইতিহাস রচনায় অনবদ্য অবদান রাখেন এবং পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকদের ইতিহাস রচনার পথ সম্প্রসারিত করেন।
আব্বাসীয় যুগের খলীফাদের উদার পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার ন্যায় দর্শন শাস্ত্রও মুসলিম মনীষীদের ছোঁয়ায় নবরূপে রূপায়িত হয়। আব্বাসীয় খিলাফতকাল শুধুমাত্র বিজ্ঞান ও দর্শনের ক্ষেত্রেই স্বর্ণযুগ হিসেবে চিহ্নিত হয়নি বরং বক্তৃতা, পত্রলিখন ও কল্পনা প্রসূত সুকুমার সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রেও এ যুগের আরব মনীষীগণ অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন।
আব্বাসীয়দের সুদীর্ঘ শাসনামলে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিটি শাখায় উনড়বতির সাথে সাথে বিভিনড়ব ধরনের ইমারত নির্মাণে ধর্মীয় ও লৌকিক স্থাপত্যের বিকাশে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছিল। মুসলমানদের এ বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্রে আব্বাসীয় যুগ বিশ্ব ইতিহাসে স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত। আব্বাসীয় খলীফাদের উদার পৃষ্ঠপোষকতায় এ যুগে মুসলমানদের এ বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য উপাদান। ইসলাম ও ইতিহাস বিষয়ক জ্ঞান-পিপাসু ও গবেষকগণের নিকট বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসের গ্রন্থাবলিতে ছড়ানো-ছিটানো এ বিষয়ে এ যাবৎ কোন প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণাকর্ম সম্পাদিত হয়নি। তাই গবেষণার জন্য আমরা এ বিষয় নির্ধারণ করেছি। এছাড়া আমি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের একজন ছাত্র হওয়ায় শিক্ষানবিশ জীবনে আব্বাসীয় শাসনামল সম্পর্কে অধ্যয়ন করার সুযোগ পাই। জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, ধর্ম ও দর্শন চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল যুগের অধিকারী হওয়ায় শিক্ষা জীবন থেকে এ যুগ সম্পর্কে বিস্তৃত জ্ঞান লাভের প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তাই এম. এ ডিগ্রী সম্পনড়ব করার পর আব্বাসীয় শাসনামল সম্পর্কে গবেষণার প্রতি আমার এ সুপ্ত আকাক্সখাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য এ বিষয়ে গবেষণা করার মনস্থ করি। কিন্তু এ গবেষণার শিরোনাম কিভাবে সুবিন্যস্ত করব তা নিয়ে অনেকটা বিড়ম্বনায় পড়ি। এক্ষেত্রে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ ও শিক্ষা প্রবর বন্ধু-বান্ধব এবং পরম শ্রদ্ধেয় ভাই প্রফেসর ড. নিজাম উদ্দীন ও প্রফেসর ড. মোহাম্মাদ বেলাল হোসেন আব্বাসীয় যুগে মুসলমানদের নতুন নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা ও চেতনায় যে সকল সাফল্য অর্জিত হয়েছিল তার সমন্বয়ে গবেষাণার জন্য আমাকে অনুপ্রাণিত করেন। তাঁদের অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে ও সুপারভাইজারদ্বয়ের পরামর্শক্রমে অবশেষে আমি আব্বাসীয় শাসনামলে মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ : একটি পর্যালোচনা এ অভিসন্দর্ভের শিরোনাম হিসেবে নির্ধারিত করি। আব্বাসীয় যুগে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে মুসলমানদের অবদানের বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান এ গবেষণাকর্মের মুখ্য উদ্দেশ্য।
Description:
এই অভিসন্দর্ভটি আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, বাংলাদেশে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য উপস্থাপিত হয়েছে।